প্রাকৃতিক দুর্যোগ (Natural Disaster) হলো একপ্রকারের প্রাকৃতিক ঘটনা, যাতে
মানুষের আর্থ-সামাজিক ক্ষতি হয়ে
থাকে। যদিও তা স্বাভাবিক প্রাকৃতিক
ঘটনা হিসেবেই ঘটে থাকে, তবে অনেক
ক্ষেত্রে মানুষের কাজ-কর্মের
প্রভাবে প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট হওয়ায় এরকম ঘটনা ঘটে থাকে।
সাধারণ ভাষ্যে, প্রাকৃতিক দুর্যোগ
হলো স্বাভাবিক প্রাকৃতিক নিয়মের
ব্যতিক্রম।
** বিভিন্নরকম প্রাকৃতিক
দুর্যোগ :-
প্রাকৃতিক দুর্যোগ মূলত স্বাভাবিক
প্রাকৃতিক নিয়মের মধ্যে ব্যতিক্রম
ঘটনা বা ঘটনাবলী। সে হিসাবে,
প্রাকৃতিক সাধারণ নিয়মের ব্যতয়
যেকোনো ঘটনাই প্রাকৃতিক দুর্যোগ
হিসেবে চিহ্নিত হতে পারে। তবে যুগ যুগ ধরে মানুষের কাছে প্রাকৃতিক
দুর্যোগ হিসেবে চিহ্নিত কতিপয় ঘটনা
রয়েছে, যেমন:
1. ঝড় :-
কোনো স্থানের বায়ুমণ্ডলে কোনো
কারণে বায়ু গরম হয়ে গেলে তা উপরে
উঠে যায়, এবং সেই শূণ্যস্থান পূরণ
করতে আশেপাশের বাতাস তীব্র বেগে
ছুটতে শুরু করে। সাধারণত প্রচণ্ড
গরমের সময় কোনো স্থানে এরকম ঘটনা ঘটতে দেখা যায়। আর এরকম তীব্র
বায়ুপ্রবাহকে ঝড় বলা হয় এবং এর ফলেই ক্ষতিগ্রস্থ হয় বিভিন্ন
মানববসতি। সাধারণত এরকম ঝড়ের
সাথে অনুষঙ্গ হিসেবে উপস্থিত হয়
স্থলঘূর্ণিঝড় বা টর্নেডো, কিংবা
বজ্রবিদ্যুৎ। উত্তর গোলার্ধের দেশ বাংলাদেশে সাধারণত বাংলা বৈশাখ মাসে প্রচণ্ড গরমের সময় হঠাৎ করেই
এজাতীয় ঝড় হতে দেখা যায়, যার
স্থানীয় নাম কালবৈশাখী ।
2. টর্নেডো (Tornado) :-
টর্নেডো হল বায়ুস্তম্ভের আকারে সৃষ্ট প্রচণ্ড বেগে ঘূর্ণায়মান ঝড় যা মেঘ (সাধারণত কিউমুলোনিম্বাস , ক্ষেত্রবিশেষে কিউমুলাস ) এবং পৃথিবীপৃষ্ঠের সাথে সংযুক্ত থাকে।
টর্নেডোর আকৃতি বিভিন্ন ধরনের হতে
পারে, তবে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এটি
দৃশ্যমান ঘনীভূত ফানেল আকৃতির হয়, যার চিকন অংশটি ভূপৃষ্ঠকে স্পর্শ করে
এবং এটি প্রায়শই বর্জ্যের মেঘ
দ্বারা ঘিরে থাকে। অধিকাংশ টর্নেডোতে বাতাসের
গতিবেগ থাকে ঘণ্টায় ১৩০ মাইলের
(ঘণ্টায় ১৭৭ কিমি) কাছাকাছি,
ব্যাপ্তি প্রায় ২৫০ ফুট (৭৫ মিটার)
এবং দ্রুত নিঃশেষ হবার আগে এটি
কয়েক মাইল বা কিমি পথ পাড়ি দিতে পারে। কিছু টর্নেডো আরো বেশি
শক্তিসম্পন্ন হতে দেখা যায়; ঘণ্টায়
এগুলোর বাতাসের গতিবেগ থাকে ৩০০
মাইল বা ৪৮০ কিমি-এর বেশি,
ব্যাপ্তিতে প্রায় এক মাইল বা ১.৬
কিমি-এর অধিক এবং ভূমির উপর দিয়ে মাইলের পর মাইল প্রায় ১০০ কিমি-
এরও অধিক দূরত্ব এগুলো অতিক্রম করতে পারে।
যদিও এন্টার্কটিকা মহাদেশ ছাড়া প্রায় সর্বত্রই টর্নেডো দেখা যায়,
সবচেয়ে বেশি টর্নেডো সংঘটিত হয় যুক্তরাষ্ট্রে ।
এছাড়া দক্ষিণ কানাডা , দক্ষিণ এশিয়া (বিশেষ করে বাংলাদেশ এবং পূর্ব ভারত ), দক্ষিণ আমেরিকার পূর্বমধ্যাংশ, আফ্রিকার দক্ষিণাংশ, উত্তরপশ্চিম এবং
দক্ষিণপূর্ব ইউরোপ , ইটালি , পশ্চিম এবং দক্ষিণপূর্ব অস্ট্রেলিয়া এবং নিউজিল্যান্ডে টর্নেডো হতে দেখা যায়।
3. জলোচ্ছ্বাস (Turnagain Bore):-
জলোচ্ছ্বাস এক ধরণের প্রাকৃতিক দূর্যোগ। বিভিন্ন কারণে এ ধরণের প্রাকৃতিক দূর্যোগের সূচনা হতে পারে। সমুদ্রের পানি ফুলে ফেঁপে উঠে উপকূলে আঘাত হানাকে জলোচ্ছ্বাস নামে অভিহিত করা হয়। সমুদ্রের পানি বিভিন্ন কারণে ফুলে ফেঁপে উঠতে পারে। তবে সবচেয়ে বেশি যে কারণে এটি ঘটে তা হলো ঘূর্ণিঝড়আর সুনামি। সুনামির ক্ষেত্রে সমুদ্রেরপানি সর্বোচ্চ প্রায় ৬৫ মিটার উঁচু হয়ে উপকূলেআঘাত হানতে পারে।
4. বন্যা (Flood):-
কোনো অঞ্চলে প্রবল বৃষ্টি হলে নদ-নদী
বা ড্রেনেজ ব্যবস্থা নাব্যতা হারিয়ে
ফেললে অতিরিক্ত পানি সমুদ্রে গিয়ে
নামার আগেই নদ-নদী কিংবা ড্রেন
উপচে আশেপাশের স্থলভাগ প্লাবিত
করে ফেললে তাকে বন্যা বলে। তবে বন্যা কোনো সাময়িক জলাবদ্ধতা নয়,
বরং একটি দীর্ঘকালীন দুর্যোগ, যা
কয়েক সপ্তাহ থেকে শুরু করে কয়েক মাস
পর্যন্ত স্থায়ী হতে পারে। উপকূলীয়
দেশসমূহ নিজ দেশ ছাড়াও মহাদেশীয়
অবস্থানের দেশগুলোর অতিবৃষ্টিপাতের কারণে নদ-নদীর
জলস্থর বৃদ্ধির কারণেও বন্যায়
প্লাবিত হতে পারে। বাংলাদেশ এরকমই একটি দেশ, যা ভারতের অতিবৃষ্টির প্রভাবেও বন্যায় প্লাবিত
হয়।
5. ভূমিকম্প (Earthquake):-
ভূত্বকের নিচে টেকটনিক প্লেটের নড়াচড়ার ফলে ভূপৃষ্ঠে যে কম্পন অনুভূত
হয়, তাকে ভূমিকম্প বলে। ভূমিকম্প মাপার ক্ষেত্রে সাধারণত
বিশ্বব্যাপী রিখটার স্কেল ব্যবহৃত হয়, তবে সংশোধিত মার্কলি স্কেল ও স্বীকৃত। রিখটার স্কেলে ১ মাত্রার
ভূমিকম্প হলো সর্বনিম্ন মাত্রা, আর
সর্বোচ্চ মাত্রা হলো ১০। পৃথিবীর
ইতিহাসে মারাত্মক সব ভূমিকম্প
নথিভুক্ত করা হয়েছে। টেকটনিক প্লেট
ছাড়াও আগ্নেয়গিরির অগ্নুৎপাতেও ভূমিকম্প সংঘটিত হতে পারে।
ভূমিকম্পের ফলে ভূত্বকের উপরে থাকা
স্থাপনা কম্পন সহ্য করতে না পারলে
ভেঙ্গে পড়ে। সমুদ্রে ভূকম্পন হলে
পানিতে আলোড়ন সৃষ্টি করে, ফলে সংঘটিত হয় সুনামি ।
6. সুনামি (Tsunami):-
কোনো বিশাল জলক্ষেত্রে, বিশেষ করে
সমুদ্রে, ভূমিকম্প সংঘটিত হলে
সেখানটায় ভুত্বকে যে আলোড়ন সৃষ্টি
হয়, তার প্রভাবে উপরস্থিত জলক্ষেত্র
ফুঁসে উঠে বিপুল ঢেউয়ের সৃষ্টি করে।
এই ঢেউ প্রবল বিক্রমে স্থলভাগের দিকে এগিয়ে আসে এবং স্থলভাগে
আছড়ে পড়ে বিপুল ক্ষয়ক্ষতি ঘটায়।
সাধারণত ভূমিকম্পের পরে সুনামি ঘটে
থাকে। তবে ভূমিকম্পের পর যে সুনামি
হবেই এমন নিশ্চয়তা দেয়া যায় না
বলেই উপকূলীয় এলাকায় ভূমিকম্প সংঘটিত হলেই উপকূলীয় জনসাধারণ
এব্যাপারে সর্বদা প্রস্তুত থাকতে
পারে না। আর ভূমিকম্প সংঘটিত হলেই
তারা নিজেদের আবাস ত্যাগ করতেও
পারে না। ফলে উচ্চমাত্রার ভূকম্পনের
পরে হওয়া সুনামিতে সাধারণত জনক্ষয় রোধ করা যায়, কিন্তু কোনো সুনামিতেই
স্থলভাগের স্থাপনার ক্ষয়ক্ষতি রোধ
করা যায় না।
7. ভূমিধ্বস (Landslide):-
পাহাড়কাটা, পাহাড়ের বৃক্ষনিধন এবং
তার সাথে অতিবৃষ্টি যোগ হলে
সাধারণত ভূমিধ্বস হতে পারে। তবে
পাহাড় কাটা বা বনভূমি ধ্বংস না
হলেও পাহাড়ের মাটি বৃষ্টির কারণে
আলগা হয়েও যেকোনো সময় এমন ভূমিধ্বস সৃষ্টি করতে পারে। ভূমিধ্বসে
সাধারণত উঁচু কোনো স্থান, যেমন
পাহাড়, থেকে গাছপালা, স্থাপনাসহ
বিপুল পরিমাণ মাটি কিংবা পাথর
অকস্যাৎ হড়কে নিচের দিকে নেমে
আসে। কখনও পাহাড়ের মাটি পানির সাথে মিশে ঘন মিশ্রণের সৃষ্টি করে,
যা অনেক সময়ই জীবিতদের আটকে
রাখার মতো আঠালো হয়ে থাকে এবং
প্রাণঘাতি হয়। তাছাড়া অকস্যাৎ
পাহাড়ধ্বসে পাহাড়ের পাদদেশে
থাকা মনুষ্যবসতিতে বিপুল প্রাণনাশ হয়ে থাকে। সাধারণত বৃষ্টিপাতের
কারণে ভূমিধ্বস হয়। বাংলাদেশে
চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, বান্দরবান,
সিলেট, নেত্রকোণা ইত্যাদি জেলায়
প্রায়ই ভূমিধ্বস হয়ে মানুষের
প্রাণহানি ও বাড়িঘর নষ্ট হয়।
8. নদীভাঙন (River Erosion):-
নদীভাঙন , এক প্রকার প্রাকৃতিক দুর্যোগ । নদীর সমুদ্রে গিয়ে পড়ার সময় সাধারণত সমুদ্রের কাছাকাছি হলে
তীব্র গতিপ্রাপ্ত হয়। তখন পানির
তীব্র তোড়ে নদীর পাড় ভাঙতে থাকে। নদীর পানির স্রোতে নদীর পাড়
ভাঙার এই অবস্থাকে নদীভাঙন বলে।
***Mission Geography***
*Edited by Sourav Sarkar.
Advertisements